এই নিয়েছে ঐ নিলো যা!
কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
চিলে কান নেয়ার এই কবিতা যখন লেখা হয় তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলো না। বাংলাদেশ বিটিভির যুগে ছিলো। চিলে কান নেয়ার গুজব ছড়াতো কানে কানে আর এখন ছড়ায় আকাশে বাতাসে আলোকবর্ষ বেগে। এখন আমরা টেলিভিশনের যুগ পেরিয়ে লাইক ভিউয়ের যুগে আছি। বিনামূল্যে আমরা সবাই ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের চাকুরে। এই চাকুরিতে টাকা নেই পয়সা নেই, কিন্তু নিজেকে প্রকাশের আদিম খায়েশ পূরনের সহজ সুযোগ আছে। এমন সুযোগ কে ছাড়ে!
একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে তখনো ফেসবুক আসেনি। সংবাদপত্রে একটি চিঠি ছাপালে সেটি নিয়ে তখন কি হুল্লোড়ই না হতো! লেখালেখি যারা করতো তারা বেশ নাক উঁচিয়ে চলতো। পত্রিকা অফিস ঘুরে ঘুরে ‘একটি লেখা ছাপানোর জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষয় করে ফেলা’ কত বিখ্যাত লেখকের জীবনের গল্প।
পত্রিকাওয়ালাদের ‘সেই রাম সেই অযোধ্যা’ ক্ষমতায় দারুণ আঘাত হানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। টেলিভিশন ব্যবসাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম।
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট: প্রত্যেকে নিজ পত্রিকার প্রতিবেদক, সম্পাদক, প্রকাশক
এখন আর কারো সংবাদপত্র, টেলিভিশনের জন্য অপেক্ষার করার সময় নেই। সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ পেতে ফেসবুক খুলুন। সঙ্গে সঙ্গে সেটি প্রকাশ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আশ্রয় নিন।। আর পায় কে? উত্তেজনার পারদ শুধু বাড়তেই থাকে। বাড়তে থাকে লাইক ভিউ কমেন্ট।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তারা শুধু নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে। ভালো কিছু, সুন্দর কিছু তাদের চোখে পড়ে না। আবার আরেক পক্ষের অভিযোগ সাংবাদিকরা তথ্য চেপে যান। নিজ প্রোফাইলে আমরা প্রতিদিন কতশত সত্য-অসত্য-অর্ধসত্য নেতিবাচকতার চর্চা করছি তার খবর কে রাখে? তথ্যের সঠিকতা নিরূপনের আগেই সে নিজেই প্রতিবেদক, নিজেই সম্পাদক, নিজেই প্রকাশক তার প্রোফাইল পত্রিকার। অন্যদের সাথে তার প্রতিমুহূর্তের প্রতিযোগিতা। যে সবার আগে দিতে পারবে তার লাইক-ভিউ সবচেয়ে বেশি। পিছিয়ে থাকতে কে চায়? পূর্বে যেমন এই প্রতিযোগিতা প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ছিলো। এখন তারাও সোর্স হিসেবে ফেসবুককে ব্যবহার করে। অবশ্য অনেক টেলিভিশন ব্রেকিংয়ের ইঁদুর দৌঁড়ে তথ্য যাচাইয়ের চেয়ে সেটি আগে ব্রেক করে দর্শক ধরে রাখার নির্মম খেলায় লিপ্ত। ভুল হলে নামিয়ে ফেলে। নিউজ চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে হরহামেশায় এমন কাজ করে। পূর্বের ভুলের জন্য তাদের কোন ক্ষমা চাইতে হয়না, ভুল স্বীকারও করতে হয় না। একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদ মাধ্যম সেটি সংবাদপত্র হোক, টেলিভিশন হোক, অনলাইন হোক তার একটি ভুল তথ্য কতভাবে প্রচারিত হতে পারে এই বিষয়ে তাদের সম্যক জ্ঞান নেই এ কথা বলার সুযোগ নেই। তাহলে কেনো তারা এমন করেন? বাজার। লাইক ভিউ কমেন্ট আর জনপ্রিয়তার লোভে গণমাধ্যমের মৌলনীতি বেনোজলে ভাসিয়ে দিয়ে ব্যবসা করতে চায়।
রিউমার হিউমার ভিউ মোর
আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রিপোর্টিংয়ে কাজ করি। গত ৩টি বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পত্রিকা বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকে তিন তিনবার জীবনের ওপারে পাঠিয়েছে। বেচারা শেষ পর্যন্ত একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে মনের দুঃখে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন ‘আমার মৃত্যুর সংবাদ আমাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে দেবেন।’ দুদিন আগে হেফাজতের আমির মৌলানা আহমদ শফির মৃত্যুর খবর একটি পরিচিত অনলাইন প্রচার করে। বান্দরবান থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেয় টেলিভিশনের এক সাংবাদিক। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেলো পুরোটাই ভুয়া। শুধু কি তাই সমাজে রাষ্ট্রে পরিচিতজনরাও সামাজিক মাধ্যমে এমন বালখিল্য আচরণ করে যেটি কোনভাবেই কাম্য নয়। ব্রাক্ষনবাড়িয়ায় এক জনপ্রিয় কওমি হুজুরের মৃত্যুতে যেভাবে এলাকাটি নিয়ে ট্রল করা হলো যেনো এমন হুজুর, এমন জানাজা শুধু ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় হওয়া সম্ভব। আর কোথাও নয়। করোনাকালীন মৃত্যু, লকডাউন এসব নিয়ে স্ট্যাটাস না দিলে যেনো কারো এখন জাত থাকে না। নেতিবাচক তথ্য প্রচারে হয়তো কোন আইনী বাধা নেই । যদি না সেটি সম্পূর্ণ গুজব হয়। সম্পূর্ণ গুজবই ছড়ালে সমালোচিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের যৌক্তিকতায় প্রমাণ করা হয়। অসম্পূর্ণ, অর্ধ-সত্য, পূর্ণ মিথ্যা কি ছড়ানো হচ্ছে না! একজন গুজব ছড়াচ্ছেন, আরেকজন নিজ দায়িত্বে অন্যের কাছে পাওয়া তথ্য অবাধে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কেনো? কারণ তিনি ভাবছেন তিনি পিছিয়ে পড়ছেন। তার ‘স্ট্যাটাস’ ডাউন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা বুঝে গেছি স্ট্যাটাস দিয়ে স্ট্যাটাস ধরে রাখতে হয়! না হয় কেউ মোরে চিনিলনা! রিউমার না ছড়ালে ভিউ মোর হইবে কেমনে!
হজমী ট্যাবলেট কোথায় পাবো!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যারা ব্যবহার করেন তাদের বেশিরভাগ এমন যে, বিকেল হতে হতে কোন বিষয়ে কোন স্ট্যাটাস না দিলে বেশিরভাগ ইউজার অস্থির হয়ে পড়ে। তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন হয়তো। বাঁচার উপায় হলো দাও একটা কিছু লিখে। যদি কিছু না পাও অন্যের উগরে দেয়া তথ্য কোন ধরণের বাচবিছার ছাড়াই শেয়ার করে দাও। তাতে কার কি যায় আসলো? আমি তো একটু সুখ পেলাম। আত্মরতির এমন বিকৃত আচার এই সময়েই সম্ভব, আমাদের পক্ষেই সম্ভব।
ফেসবুকে সংক্ষিপ্ত শব্দে কিছু লিখা, কোন ছবি পোস্ট করা, কোন সমালোচনা করা, নেতিবাচক তথ্য প্রচারের মহা আনন্দ আছে। এটি তাৎক্ষনিক, এর একটি নয়েজ (গোলমাল) তৈরী করার ক্ষমতা আছে। শিয়ালের মতো এক শিয়ালের হুক্কা হুয়ায় হাজারো শিয়ালের হুক্কা হুয়া রব তোলার সুযোগ আছে। ঐ বিষয়ে জ্ঞান থাক বা না থাক একটা কিছু লিখে দিতে কেউ বাধা দিচ্ছে না। তো দাও লিখে। পরে কি হবে সেটি ভাবলে তো এই মুহূর্তে হাজার লাইক, ভিউ, কমেন্ট পাওয়ার সুযোগ হেলায় হারাবো। এমন সুবর্ণ সুযোগ কে হারাতে চায়!
এমনিতেই আমরা খুব নাচুনে। আমরা শুরু করি যত আড়ম্বরে শেষ করি তত বিড়ম্বনায় তত নিরবে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আক্ষেপ করেন, করোনা শুরুর সময় মানুষের মধ্যে ত্রাণ দেওয়ার অস্থিরতা, ছবিতে সামাজিক মাধ্যম ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবনতায় এখন ভাটার টান কারণ কি? নিরন্ন মানুষের ত্রাণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে নাকি?
আসলে কিছুই ফুরিয়ে যায়নি। আমরা কোন উত্তম কাজের উত্তেজনা বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না। টায়ার্ড হয়ে যাই। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকীর খাতা শূন্য । দিনে আনে দিন খাওয়া মানুষের তাই বেঁচে থাকার অবলম্বন ‘স্ট্যাটাস’। স্ট্যাটাস সংকটে ভোগা আমাদের সেই রক্ষা করার ওষুধ বাতলে দেয় ফেসবুক। আমরা হৈ হৈ রব তুলে লেগে থাকি প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় নিয়ে। রিউমার ছড়িয়ে ভিউ মোর করে আমরা যে ধীরে ধীরে একটি জড়বুদ্ধিগ্রস্থ কৌতুককর মানুষে পরিণত হই সেই পরিপূর্ণ চিন্তা করার ধৈর্য্য, সহ্য, গভীরতা সব যেনো সিলিকন ভ্যালির কাছে বন্ধক দিয়ে নগ্ন নৃত্যের খেলায় আছি।
অবশ্য কথা বলার সুযোগ যখন কমে যায়, মুক্ত চর্চা যখন বাধাগ্রস্থ হয়, সমস্যা বলার ও সেটি সমাধানের যখন কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকে, যখন গণমাধ্যম থেকে গণ উধাও হয়ে যায় তখন সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘করে নাতো ফোঁসফাঁস মারে না তো ঢুশঢাশ টাইপ’ ঢোড়া সাপের মতো শুধু হিসহিস চলার আওয়াজ ছড়ানোকে গুজব বলি কেমনে? আর কিছু না হোক মনের জ্বালা তো মিটছে। তথ্য দেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমের টুটি জেনে বুঝে চেপে ধরলে গুজবের বাড়বাড়ন্ত হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবিষ্যতবানী আজো কি প্রাসঙ্গিক নয়?
শুধু অনুরোধ নিজের স্ট্যাটাস, লাইক, ভিউ, কমেন্ট বাড়াতে গিয়ে কারো বোন, কারো ভাই, কারো নিকটাত্মীয়কে মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর স্বাদ পাইয়ে দেবেন না। কেনো আমাদের সবকিছু নিজের ক্ষতি হওয়ার পর শিখতে হবে। কেনো আমরা কানের খোঁজ করার আগে হাত দিয়ে কানটা জায়গা মতো আছে কিনা দেখবো না?
সম্রাট আকবর একবার সভ্য বীরবলকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
সত্য থেকে মিথ্যার দূরত্ব কতটুকু?
বীরবলের উত্তর,
কান থেকে চোখের দূরত্ব যতটুকু।
এখন হলে হয়তো বলতেন চোখ থেকে ফেইসবুকের দূরত্ব যতটুকু।
পবিত্র হাদিসে আছে, আল ফিৎনাতো আসাদ্দু মিনাল কতল।
ফিৎনা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়ে জঘন্য পাপ। গুজব ব্যক্তি সম্পর্কে, সমাজজীবনে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ফিৎনা তৈরী করে । আপনি নিজের অজান্তে অবৈতনিক অস্থিরতায় ভুগে গুজব ছড়িয়ে হত্যার চেয়ে জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত নয়তো? ঈশ্বর আমাদের ধৈর্য্যের সাথে তথ্য বিচারপূর্বক ব্যবহারের শক্তি, সামর্থ্য ও সক্ষমতা দান করুক।
বাংলাদেশ সময়: ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ জুন ২০২০
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com