শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। কারণ করোনা। শিক্ষা ব্যবস্থা যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এ থেকে উত্তরণের পথ কী? এতদিন শ্রেণিকক্ষে নেই পাঁচ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। পরীক্ষা নেই। তার চাপ নেই। চাকরির পরীক্ষা নেই। কবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
প্রায় পাঁচ দশক আগে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা স্মরণ করতে পারি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আমরা দলে দলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মঘট করে বের হয়ে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল সর্বত্র অভিন্ন চিত্র। একদল পাকিস্তানি হানাদারদের সামরিকভাবে পরাভূত করার জন্য যোগ দিই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। অন্যরা নানাভাবে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র সমাজের ছিল অনন্য অবদান। সাধারণত রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে বিপরীত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছিল অগ্রণী ভূমিকা। এখানেই প্রথম ঐতিহাসিক বটতলার সামনের ছাত্রসমাবেশে লাল-সবুজ পতাকা তোলা হয়, যা পরে জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী এতই ক্ষুব্ধ হয় যে ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই গণহত্যা শুরুর জন্য বেছে নেয়। যে বটতলার পাদদেশে প্রথম পতাকা তোলা হয়েছিল সেই বটগাছটিকেও তারা শেকড়সহ উপড়ে ফেলে।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে দৃঢ়সংকল্পে চলার আরেক স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারও গুড়িয়ে দেয় তারা। ১ মার্চ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মঘট করে বের হয়ে জয় বাংলা ধ্বনি তুলে মিছিলে যোগ দিই। সঙ্গে আরও হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। যুদ্ধ জয় শেষে প্রিয় এ প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি। সে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের স্মরণে নানা আয়োজন হয়েছিল। ২৫ মার্চ জগন্নাথ হল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণের শিকার হয়। ১৯৭৪ সালে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংকে রক্ত বিক্রি করে এ হলের শহীদ শিক্ষক ও ছাত্রদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করি।
বরিশালের গৌরনদীতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে থাকার সময়েই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার খবর পাই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি প্রিয় স্বদেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্তের ছিল সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য। প্রায় এক বছর আমাদের শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে ছাত্র বা ছাত্রী যে ক্লাসে ছিল, ১৯৭২ সালের শুরুতে সেই শিক্ষা বর্ষেই পড়বে। যে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছিল, সে শ্রেণিতেই থাকবে। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী দশম শ্রেণিতেই পড়বে। আমি তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেই ক্লাসেই ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু বলেন, ছাত্রদের শিক্ষা জীবন থেকে একটি মূল্যবান বছর ঝরে গেছে। তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে। চাকরিতে যোগদানের অপেক্ষা বেড়েছে। কিন্তু এই এক বছরটিকে আমরা উৎসর্গ করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য। পড়াশোনা না করেই প্রমোশন পেলে শিক্ষা অপূর্ণ থেকে যাবে।
সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালে এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে সব প্রহসনের পরীক্ষা নিয়েছিল, তার ফলও বাতিল করা হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরবর্তী ঐতিহাসিক সময়েও শর্টকাটে চলতে চাওয়া লোকের অভাব ছিল না। কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ-মিছিল করে অটো প্রমাশন বা পরীক্ষা না দিয়েই পাস করিয়ে দেওয়ার দাবি তোলে। ঢাকা শহরের কয়েকটি কলেজ থেকেও মিছিল হয়। বিশেষ করে অনার্স ও বিএ-বিকম-বিএসসি পরীক্ষা সামনে রেখে এ দাবি জোরদার হয়। বটতলায় এ দাবির পক্ষে একটি সমাবেশে অটোপ্রমাশনের দাবির বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহবুবজামান ও আমি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হই। বিক্ষুব্ধ কিছু শিক্ষার্থী ২০ জুলাই (১৯৭২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে। কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উপাচার্যসহ সকলকে কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তখন রমনা এলাকায় সে সময়ের গণভবনে একটি সভায় ছিলেন। তিনি খবর পেয়ে ছুটে এসে উপাচার্যকে উদ্ধার করেন এবং শিক্ষার্থীদের ভৎর্সনা করেন।
পরদিন ছিল সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন। বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণে পরীক্ষা না দিয়ে পাসের দাবির কঠোর সমালোচনা করেন। শিক্ষকদের অপমান যারা করেছে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা ছাত্র আন্দোলন করেছি, কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া পাসের দাবি কখনও করিনি। দৈনিক সংবাদ ও ইত্তেফাকে এ দাবিকে অন্যায় ও আত্মঘাতী হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্পাদকীয় লেখা হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী পড়ছে। কয়েকদিন আগে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। পাস করেছে প্রায় ১৭ লাখ ছাত্রছাত্রী। এদের মধ্যে ছাত্র ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯২ এবং ছাত্রী ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৬৩১ জন। বিশ্বে ১৬৬ টির বেশি দেশ রয়েছে, যার কোনোটিতেই ১৭ লাখ লোকসংখ্যা নেই। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে, সে বিষয়ে দ্বিমত করা চলে না। কিন্তু এখন বস্তিতে কিংবা হতদরিদ্র পরিবারেও মাধ্যমিক পাস ছেলে বা মেয়ে রয়েছে, এটাই বাস্তবতা। কয়েক বছর আগে এক ধনবান লোকের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। উপলক্ষ, ছেলের জিপিএ-৫ প্রাপ্তি। যে কাজের বুয়া খাবারের এঁটো পরিষ্কার করছিল, আমাদের কয়েকজনকে শুনিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেছিল, আমার মাইয়াও পাঁচ পাইছে। তার গর্বিত মুখমণ্ডল ভুলতে পারি না।
২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৬ লাখ ৫০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী, উচ্চমাধ্যমিকের ৫ লাখ ৭৮ হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, ডিগ্রির ২ লাখ ছাত্র-ছাত্রী উপবৃত্তি পাবে। পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মেধাবৃত্তি পাবে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ছাত্র-ছাত্রী। সরকার স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন দেয়, স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের প্রায় সবটাই বহন করে। বেসরকারি খাতে যে সব উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ব্যয়ের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা খাতে ব্যয় নামমাত্র। শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবি রয়েছে এবং তা যৌক্তিকও। যদি স্কুল-কলেজে ভাল বেতন ও মর্যাদা মেলে, তাহলে সেরা ছাত্র-ছাত্রীরা প্রশাসন ও শিল্প-বাণিজ্যের বড় প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষকতাকেও পেশা হিসেবে বেছে নিতে উৎসাহ দেখাবে।
আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বলি। আমি উচ্চ মাধ্যমিকের ফলের কারণে তিন বছরের মেধাবৃত্তি পাই। ১৯৭১ সালের জুন মাসে এর মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে বকেয়া অর্থ পাই, অনার্স কোর্স এক বছর বেশি পড়তে হওয়ায় বৃত্তির মেয়াদও এক বছর বাড়ানো হয়। বৃত্তিপ্রাপ্ত সকলের জন্যই এটা প্রযোজ্য ছিল।
করোনা দুর্যোগকালে প্রায় চার মাস শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। আরও এক মাসের বেশি বন্ধ থাকার ঘোষণা এসেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কবে অনুষ্ঠিত হবে, সেটা অনিশ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি অনিশ্চিত। কেউ কেউ সঙ্গত কারণেই পরিস্থিতিকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে তখন প্রতি মুহূর্তে ছিল প্রাণ হারানোর ভয়ঙ্কর শঙ্কা। লাখ লাখ শিক্ষার্থী অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে। শিক্ষকরা চরম ঝুঁকিতে। এখন সে অবস্থা নেই। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যে বিস্তার ঘটেছে তার সুফল প্রায় সব ঘরেই ভোগ করতে পারছে। সরকারি ভাণ্ডার থেকে যে সব শিক্ষকের বেতন-ভাতা পাওয়ার কথা, তাতে ব্যাঘাত ঘটছে না। তাহলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছাত্র-শিক্ষক-অবিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কেন যাবে না?
যদি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান আরও কয়েক মাস বিঘ্নিত হয়? যদি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ আরও পিছিয়ে যায়? যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে মিড টার্ম ও সেমিস্টার ফাইন্যাল পরীক্ষা গ্রহণে অনিশ্চয়তার সময় প্রলম্বিত হয়?
এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্তদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া অনুচিত বলেই আমি মনে করি। কারণ তারাই এ শিক্ষা প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে থাকেন। তবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় দায়িত্ব ও কর্তব্যের সীমারেখা টেনেছেন এভাবে তাঁর নিজের ক্যান্সার চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র রয়ে গেছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু তিনি আমেরিকায়। চিকিৎসার জন্য এর জরুরি প্রয়োজন পড়ায় যে অফিসে তা রয়েছে, সেখানে ফোন করেন। তখন অফিস ছুটির সময় হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট অফিসার বলেন, পরদিন ব্যবস্থা করবেন। অফিসের পরেও তার কিছু কাজ ছিল, সে সব সম্পন্ন করে তিনি ওই রাতেই অমর্ত্য সেনের ক্যান্সার চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র বের করে আমেরিকা পাঠিয়ে দেন। অমর্ত্য সেন এটাকেই বলেছেন কর্তব্যবোধ। ওই কর্মকর্তা পরদিন অফিসে এসে এ কাজ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি অন্তরাত্মার ডাক শুনেছেন। তাই একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার কাগজপত্র যত দ্রুত পাঠানো যায়, সে জন্য উদ্যেগী হয়েছেন।
করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়েছে এবং যে ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার কর্তব্যবোধ জাগ্রত হতে হবে, অন্তরাত্মার ডাক শুনতে হবে। আমাদের শিক্ষার মান বাড়ানোর তাগিদ অনেক দিনের। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা-ক্ষতি। উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের তাগিদ যতটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতর-অধিদফতর থেকে আসতে হবে, সমভাবেই আসতে হবে শিক্ষকদের কাছ থেকে। বিশেষভাবে প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্তদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অভিপ্রায় এবং তাদের সে সুযোগ প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি ভাবতে হবে। কিছু প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে যতটা জানি, তারা পরিচালিত হচ্ছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশদ্বারা।স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ তুলনামূলকভাবে কম।
টেলিভিশনে পাঠদান হচ্ছে। ইন্টারনেট কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে সব কিছুই সীমিত পর্যায়ে। জাতীয় সর্বাত্মক উদ্যোগ বলতে যা বোঝায়, সেটা তেমন দৃশ্যমান নয়। যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স রয়েছে, এমন কলেজের কথা ধরা যাক। শিক্ষকরা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে যার যার বিভাগের পাঠক্রমের উপযোগী অ্যাসাইনমেন্ট দিতে পারেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ করোনা ও করোনা উত্তরকালের বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে রচনা লিখতে বলতে পারেন। অর্থনীতি বা সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের সামনে কত বিষয়।মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আরও ব্যাপকভাবে চিকিৎসা সেবায় যুক্ত করা যায়।
সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে করোনা মোকাবেলায় কত ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের খবর শোনা যায়। সেটা অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় হতে পারে।
করোনা-ঘূর্ণিঝড় আমফানের চরম বিপদের মধ্যেই অল্প সময়ে ২ কোটি টনের বেশি বোরো চাল কী করে ঘরে উঠল, কৃষি কীভাবে আমাদের অর্থনীতিকে ভরসা জোগাতে পারে, আমাদের ওষুধ শিল্প করোনা-পরবর্তী বিশ্বে বিকশিত হতে পারে, পোশাক শিল্প পিপিই ও মাস্ক বাণিজ্য থেকে কতটা সুবিধা তুলতে পারবে, তেলের দাম কমে যাওয়ায় আমরা কতটা লাভবান হবো কতো বিষয় এখন নানা শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, প্রকৌশল-চিকিৎসা শিক্ষা ক্ষেত্রেও পাঠদান ও পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ আসতে পারে। করোনাকাল যদি দীর্ঘায়িত হয়?যদি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা যার যার ঘরে বসেই শিক্ষার্থীদের দিতে হয়? এ প্রযুক্তির যুগে সেটা কি একেবারেই অসম্ভব? ওপেন বুক পরীক্ষার কথাও ভাবা যেতে পারে। প্রশ্ন সেভাবে তৈরি হবে। খাতা দেখেও শিক্ষকরা বুঝতে পারবেন, শিক্ষার্থীও মেধা কোন পর্যায়ে। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেন।
যদি শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষার হলে ফিরিয়ে আনতে হয়? তাহলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়বে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা। এ নিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলোর একযোগে কাজ করতে পারে। বিশেষভাবে উদ্যোগ চাই শিক্ষকদের। তাদের সংগঠনের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি। শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্ব কি কেবল বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে নিজেদের সীমিত রাখবে?
শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাড়তি বাজেট চাই। অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য যে বাজেট প্রণয়ন করেছে, তাতে অর্থনীতি সচল করার জন্য আর্থিক ও প্রণোদনা রাখা হয়েছে যথেষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সময়যোপযোগী উদ্যোগ নিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়তে পারে।
শিক্ষায় প্রযুক্তি সুবিধার ব্যবহার বাড়ছে। ছোট-বড় নানা পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর স্লোগান বাস্তবায়নে হাত দিলেন, কত বিরূপ সমালোচনা। কিন্তু গত ১১ বছরে কতই না অগ্রগতি। এর সুবিধা কমবেশি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ভোগ করছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, সমাজে ধনি-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুবিধায় বিভাজন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ বিভাজন রয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা সব ছাত্রছাত্রী সমভাবে ভোগ করতে পারে না। কিন্তু তারপরও বলতে হবে, ইন্টারনেট অনেক ধরনের সুবিধায় কমবেশি সমবণ্টন নিশ্চিত করতে পারছে। শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।
সবশেষে বলব, যদি করোনাকাল তুলনামূলক দীর্ঘায়িত হয়। আমরা যেন কোনোভাবেই কনডেন্স কোর্স বা অটোপ্রমোশন বা এ ধরনের শর্টকাট পথের কথা না ভাবি। নতুন পথে চলতে হতে পারে আমাদের। আর তার সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো যথেষ্ট উপাদান-উপকরণ আমাদের হাতে রয়েছে। এ সুবিধা সৃজনশীলভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিপর্যয় কাটানো সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৭ জুন ২০২০
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com