মুসলমানদের স্বর্ণযুগে ইসলামের উত্থানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সৌদি আরব। এরপর বাগদাদ, পারস্য ও তুরস্ক ঘুরে বহুকাল নেতৃত্বশূন্য ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। তবে এবার ধারণা করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করেই নতুন এক মুসলিম নেতা পাচ্ছে বিশ্ব মুসলমানরা।
সৌদি যুবরাজ ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মুহম্মদ বিন সালমান।
এতদিন যে সৌদি চলেছে আমেরিকার সঙ্গে আঁতাত করে, সেই সৌদিই যেন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আপন স্বকীয়তায়। মূলত সৌদি যুবরাজ ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মুহম্মদ বিন সালমানকে মুসলিম দুনিয়া তাদের নেতা হিসেবে পাশে পেতে যাচ্ছেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সম্প্রতি জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমারা নতুন করে ভাবছে। বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সফর ও ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর নেতৃস্থানীয়দের সৌদিকে তোয়াজ করে চলার প্রবণতাই প্রমাণ দিচ্ছে এমবিএস খ্যাত সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান বিশ্ব রাজনীতির মাঠেই ভালোই খেলছেন।
২০১৭ সালের ২১ জুন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে সালমানের অভিষেকে নড়েচড়ে বসেছিল সৌদি ও পুরো বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা। সংস্কারমুখী ও দৃঢ়চিত্তের সালমান ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগি হত্যা মামলায় কোণঠাসা হলেও অভিষেকের পাঁচ বছর পর ফিরে এসেছেন দ্বিগুণ শক্তিমত্তা ও কূটকৌশল নিয়ে।
একাট্টা মুসলিম বিশ্বের স্বপ্ন যেখানে ছিল অধরা, সেখানে ইরানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি, সিরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা ও ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে সালমানের পদক্ষেপগুলো হচ্ছে প্রশংসিত।
বার্তাসংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিষেকের পরপরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান সালমান। এরপর থেকে ইরানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ইয়েমেনে সৌদির যুদ্ধ পরিচালনা নানা মহলে জন্ম দেয় তীব্র সমালোচনার। সৌদি যেখানে ইয়েমেনের সরকার দলকে সমর্থন দিচ্ছে, ইরানের সমর্থন সেখানে বিদ্রোহী হুতিদের। তবে ইরান-সৌদির সংঘাত মিটে যাওয়ায় ইয়েমেনে চলমান যুদ্ধেও যে একটি আশু সমাধান আসতে যাচ্ছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কাতারকে বয়কট করা, লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ থেকে শুরু করে খণ্ড-বিখণ্ড মধ্যপ্রাচ্য এবার এক ছায়াতলে আসার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিয়েছে বলে নিজেদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এপি।
এদিকে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব সৈন্য প্রত্যাহার, এর আগে সন্ত্রাসবাদের দায়ে পাকিস্তানকে দায়ী করা, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সালমানের ওপর চাপ সৃষ্টি ও কয়েক দশক আগে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইহুদিদের পক্ষ নেয়াকে বিশ্লেষণ করে যুবরাজ সালমান বুঝতে পেরেছেন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সৌদিকে ভুলে যেতে আমেরিকার এক লহমা সময় লাগবে না। তাইতো চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বিস্তারে যা যা করা দরকার সৌদি তাই করছে।
সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব যখন একাট্টা সেখানে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও এবার স্রোতে গা না ভাসিয়ে বেঁকে বসেছেন সৌদি যুবরাজ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপরে দিচ্ছে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা সেখানে সৌদির হাত ধরে ওপেক প্লাসে রাশিয়ার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে। একইভাবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি যুবরাজ। সালমানের স্বপ্ন যেখানে স্মার্ট সৌদি গড়ে তোলা সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীন ছাড়া যে আর কোনো বিকল্প নেই সেটি বুঝতে পেরেছেন যুবরাজ।
শুষ্ক মরুভূমিকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে সালমান ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। রিয়াদের মুকাব প্রজেক্ট, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নিওম প্রজেক্টকে সফল করতে চাইলে আমেরিকার দিকে চেয়ে থেকে কোনো লাভ নেই সেটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন সালমান। তাইতো চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নেমেছেন সৌদি যুবরাজ। এদিকে চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধ মিটমাটে সালমানের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে আগের থেকে অনেক বেশি।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান মুসলিম বিশ্বের আইকন না হয়ে কেন সালমান এগিয়ে আছেন জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার দৌড়ে। গণতান্ত্রিক দেশ তুরস্কে এরদোগান আদৌ পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। বর্তমান তুরস্কের অর্থনীতির বেহাল দশায় এরদোগানের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। অন্যদিকে ৩৭ বছর বয়সী যুবরাজ সালমান বাদশাহ না হয়েও বাদশাহী ক্ষমতার অধিকারী ও ভবিষ্যতে খাতা-কলমে হতে যাচ্ছেন সৌদির বাদশাহ।
এ ছাড়া খাশোগিকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সঙ্গে সৌদির শীতল সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে এরদোগানের দেশকে। ২০২০ সালে সৌদিতে তুরস্কের রফতানি আয় ছিল ৩ দশমিক ৩২ ডলার, যা ২০২১ সালে কমে হয়েছে ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার। নিজের দেশের বেহাল দশায় এরদোগান বুঝতে পেরেছেন, উচ্চবাচ্যের থেকে সালমানের সঙ্গে সমঝোতা করলে তুরস্কের লাভ বেশি- যা গত বছরে এরদোগানের সৌদি সফরের সারমর্ম পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়।
এদিকে বিশ্ব জলবায়ু নিরাপত্তা বিষয়ক কার্যক্রমে সালমান মধ্যপ্রাচ্যে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দান করার কথা জানিয়েছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে মধ্যপ্রাচ্য যাতে রক্ষা পায় সেলক্ষ্যে এখন থেকেই সচেষ্ট সৌদি। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ‘গ্রিন অ্যানার্জি’ প্রজেক্টে এসব অর্থ দান করা হবে বলে জানান যুবরাজ এমবিএস। এ ছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে সৌদিতে কার্বন নিঃসরণের মাত্র শূন্যতে নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
মুসলিম বিশ্ব এমনকি পশ্চিমাদের কাছেও সালমান একজন চৌকস শাসক। সালমান জানেন কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে হয়। একসময় সৌদির তেল শেষ হয়ে গেলেও সৌদি যাতে শেষ হয়ে না যায় এর জন্য ঘরে-বাইরে সবখানে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলছেন যুবরাজ সালমান। যেভাবে সালমান আগাচ্ছেন তাতে করে ধারণা করা হচ্ছে মুসলমানদের পুরানো স্বর্ণযুগ ফিরে না আসলেও আবারও সৌদি আরব হবে মুসলিমদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে নায়কের ভূমিকা পালন করবেন যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান।
বাংলাদেশ সময়: ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৩
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com