বার্ড ফ্লুই কি তবে পরবর্তী মহামারি?
কম্বোডিয়ায় বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন আরও অনেকেই। পাখি কিংবা পাখি জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে এইচ৫এন১ ভাইরাস তথা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। ২০২১ সালের অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ গৃহপালিত পাখির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মুরগি উল্লেখযোগ্য। আক্রান্ত হতে পারে আরও ১৯ কোটি ৩০ লাখ প্রাণী। এ অবস্থায় বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কি বার্ড ফ্লুই পরবর্তী মহামারির রূপ নিতে যাচ্ছে?
বার্ড ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ গৃহপালিত পাখির মৃত্যু হয়েছে।
বার্ড ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ গৃহপালিত পাখির মৃত্যু হয়েছে।
ভাইরাসটি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকা কোথায় ছড়িয়ে পড়েনি? ভাইরাসটি বেশ কয়েকটি স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর প্রজাতির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এটি মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হওয়ার প্রথম রোগী ধরা পড়ে ইকুয়েডরে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে এক কিশোরীর শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ২০২২ সালে মাত্র ৫ জনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি ধরা পড়ে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে এই ভাইরাসে মানুষের মৃত্যু হার ৫৩ শতাংশ। আর এ বিষয়টিই বিজ্ঞানীদের চিন্তিত করছে বেশি।
কারণ, এইচ৫এন১ ওয়ান ভাইরাসটি বেশ দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে, রূপ পাল্টাচ্ছে। ভাইরাসটির সর্বশেষ প্রকরণটি হলো, এইচ৫এন১ ২.৩.৪.৪বি। যা আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি বেশ কয়েক প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণির মধ্যে ছড়িয়েছে। যেমন গ্রিজলি ভালুক, সি লায়ন, বিভিন্ন প্রজাতির শেয়াল এবং সিল মাছসহ বেশ কয়েক প্রজাতির প্রাণি। এসব প্রাণির সঙ্গে মানুষের শ্বাসপ্রণালির মিল থাকায় ভাইরাসটি মানুষকে আক্রান্ত করবে কিনা তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। তবে সেসব আলোচনা ছাড়িয়ে ভাইরাসটি এরইমধ্যে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে।
অন্যান্য মহামারির মতো এইচ৫এন১ এই সাব-টাইপটি মানুষের মধ্যে ততটা সংক্রামক নয়। কারণ এখন পর্যন্ত সংক্রামিত পাখির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন লোকজনই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ফলে বিজ্ঞানীদের আশা, এটি মানুষের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়াবে না।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনসের (সিডিসি) ইনফ্লুয়েঞ্জা বিভাগের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. টিমোথি উয়েকি এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, এটি জনসাধারণের জন্য সামান্যই ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে।’ ডব্লিউএইচ-ও চলতি মাসের শুরুতে এমনই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে।
কিন্তু অতীত পরিসংখ্যান ততটাও আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ, ভাইরাসটি ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশে সবমিলিয়ে ৪৬৮ জনকে আক্রান্ত করেছিল। আক্রান্তদের অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন হাঁস-মুরগির খামারের শ্রমিক। আক্রান্তদের মধ্যে ২৮২ জন মারা গিয়েছিল। বিগত ছয় বছরের হিসাবসহ ভাইরাসটি গত ২০ বছরে ৪৫৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ফলে বার্ড ফ্লু যে মানুষে সংক্রমিত হবে না সে বিষয়ে হলফ করে কিছু বলা যায় না।
ভাইরাসটি ক্রমেই বিবর্তিত হচ্ছে। চেষ্টা করছে এক প্রজাতির প্রাণি থেকে অন্য প্রজাতির প্রাণিতে স্থানান্তরিত হতে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রোগ্রামের প্রধান ওয়েঙ্কিং জাং আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ভাইরাসটির মিউটেশন আমাদের জন্য একটি সংকেত। আর তা হলো, এই ভাইরাসটি এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ার বাধা অতিক্রম করে স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।’
এবং এ কারণে, এ ভাইরাস থেকে মহামারি সৃষ্টির আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না জাং। তিনি বলছেন, ‘এইচ৫এন১ ভাইরাসের তরফ থেকে মহামারির হুমকি বর্তমানে খুব বেশি নয়। তবে আগে হোক বা পরে, আরও একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি আসন্ন।’
তবে সেটি যে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাই হবে সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলেননি জাং। তবে বলেছেন, ‘যদি সেই মহামারিটি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে হয় তবে তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সাধারণত ভাইরাসটি খুব কমই মানুষকে সংক্রামিত করে। তবে এ ভাইরাসের বিপরীতে মানুষের প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউনিটি) একেবারেই শূন্য হওয়া যদি ভাইরাসটি কোনোভাবে বিবর্তিত হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তবে তাকে প্রায় মহামারির সঙ্গেই তুলনা করা যাবে।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্টাডিজ অন ইনফ্লুয়েঞ্জার পরিচালক রিচার্ড ওয়েববি বলেছেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, ভাইরাসটি পাখিদের ক্ষেত্রে সংক্রামক হিসেবে খুবই সফল ভাইরাস এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে খুব সফল এখনো হতে পারেনি।’ না পারার কারণ হলো, ভাইরাসটি মানুষে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিবর্তিত হতে পারেনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা কেউই এ সম্ভাবনাটিকে উড়িয়ে দেননি যে, এইচ৫এন১ বা অন্য কোনো এভিয়ান ফ্লু ভাইরাস মহামারির কারণ হতে পারে। সবমিলিয়ে পুষ্টিগত, অর্থনৈতিক ও বাস্তুগতভাবে এইচ৫এন১ এরইমধ্যে একটি সংকট হিসেবে হাজির হয়েছে। এবং প্রয়োজনীয় পূর্ব সাবধানতা ব্যতীত এটি মহামারির উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com