ব্রেকিং নিউজ

x


করোনায় হাজীগঞ্জের ব্যবসা, অদূরদর্শী নেতৃত্ব ও বাণিজ্যিক শহর-জাকির মজুমদার

বুধবার, ১০ জুন ২০২০ | ৩:৫২ অপরাহ্ণ

করোনায় হাজীগঞ্জের ব্যবসা, অদূরদর্শী নেতৃত্ব ও বাণিজ্যিক শহর-জাকির মজুমদার

বৈশ্বিক মহামারি করোনা দুর্যোগ অব্যাহত। কতদিন পর্যন্ত এই ভাইরাস আমাদের জীবনযাত্রাকে বন্দি করে রাখে তা বলা দুষ্কর। একমাত্র মহান আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলার রহমত ছাড়া এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যে অসম্ভব তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু এর মাঝেও আমাদের জীবন ও জীবিকার তাগিদ আছে। তাই অত্যন্ত সচেতনতার সহিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের দৈনন্দিন জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটাতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো- প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়েই কাউকে কেনাকাটা করতে হয় অথবা কেউ তার ব্যবসার পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু এই সংক্রমণ দুর্যোগে তা যদি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে না হয়- তা আমাদের নিজ পরিবারসহ প্রতিবেশি এবং দেশকে যে কতটুকু ঝুঁকিতে আমরা ফেলছি তা কি ভেবে দেখছি?

বলছি আমার প্রিয় শহর হাজীগঞ্জের কথা। রমজানের প্রথম থেকেই বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে করোনার এই দুর্যোগে হাজীগঞ্জে ক্রেতা-বিক্রেতার যথেচ্ছার আচরণ লক্ষ্য করা যায়। যা স্থানীয় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বইয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আইনশৃঙখলা বাহিনীকে ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও পথচারীদের লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তবে এসময় হাজীগঞ্জ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাদের করণীয়, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি- তা বিভিন্নভাবে স্পষ্ট হয়েছে। যার কারণে যেমন ব্যবসায়ীরা হেনস্তা ও ক্ষতির সম্মূখিন হয়েছেন ঠিক তেমনি ক্রেতারাও হয়রানির শিকার হয়েছেন। শুরুতেই ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা যেত। যার সহায়তায় ব্যবসাও সচল থাকতো এবং স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ নিশ্চিত করা যেত। কিন্ত ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে ঈদের পর পরই শহরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীর মৃত্যুতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিরা হাজীগঞ্জ শহরকে লকডাউন ঘোষণা করে। অথচ এমন বৈঠক শুরুতেই প্রয়োজন ছিল। যাক করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় হাজীগঞ্জ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ পরবর্তী সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে এমন সমন্বয় বৈঠকের মাধ্যমে সার্বজনীনতা বজায় রাখবে- তা আমরা প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিনেও ‘হাজীগঞ্জকে একটি সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যিক কেন্দ্র’ করে গড়ে তুলতে না পারার কিছু ব্যর্থতার বিষয়ও আজ আলোচনা জরুরি বলে আমি মনে করি।

প্রাচীনকাল থেকেই হাজীগঞ্জ চাঁদপুর জেলার ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। হাজীগঞ্জকে জেলার বাণিজ্যিক রাজধানীও বলতে শুনা যায়। শুধু তাই নয়- শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকেও হাজীগঞ্জ জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে প্রাগ্রসর। জেলার মানচিত্রে হাজীগঞ্জের অবস্থান মধ্যবর্তী স্থানে। সড়ক পথ, রেলপথ ও নীদপথবেষ্টিত হাজীগঞ্জ ব্যবসা-বাণিজ্যের চারণভূমি বলা যায়। শুধু তাই নয়, পূর্ব-দক্ষিণে নোয়াখালীর ছাটখিল-বেগমগঞ্জ ও সোনাইমুড়ি এবং দক্ষিণ পশ্চিমে লক্ষীপুরের রামগঞ্জ আর পূর্বদিকে কুমিল্লার বড়ুয়া, মুদাফ্ফরগঞ্জ এবং লাকসামের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ও যাতায়াতের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে হাজীগঞ্জ শহর তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। কুমিল্লার গৌরিপুর থেকে কচুয়া সদর হয়ে হাজীগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র ছুঁয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ সদরে যে সড়ক ও জনপদটির বিস্তৃতি ঘটলো তার সুবাধে ভৌগলিক দিক থেকে গত এক দশক হাজীগঞ্জ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, নোয়াখালী ও লক্ষ্মী্পুরের মানুষ এখন ঢাকা, চট্টগ্রামে ব্যক্তিগত যাতায়াতে এবং ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহণে গৌরিপুর-হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়ককেই ব্যবহার করছে।

কিন্তু এসবকে ধারণ করে হাজীগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত যতটা শক্তিশালী ও বিস্তৃত হওয়ার কথা এবং হাজীগঞ্জে যেভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা অবধারিত ছিল- তা হয়নি। উপরুন্তু ব্যবসায়ীরাও নানান সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাবঞ্চিত। নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু যে আইনশৃঙ্খলাজনিত, তা কিন্তু নয়। ব্যবসায়িক পুঁজি ধরে রাখা বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখা, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা বা যারা ঋণ গ্রহিতা তাদের ঋণ পরিশোধ করার মতো ব্যবসায়ীক পরিবেশ গড়ে না উঠার বিষয়ও জড়িত। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রদেয় ঋণ আদায় করতে না পারায় স্থানীয় নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণিও ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অথচ হাজীগঞ্জ একটি ব্যবসা-শিল্প উৎপাদন অধ্যুষিত বাণিজ্যিক অঞ্চল হওয়ার অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা হতে না পারার জন্য আমি স্থানীয় নেতৃত্বকে দায়ী করবো। স্থানীয় নেতৃত্ব বলতে জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বুঝাচ্ছি। তাদের দূরদর্শিতার অভাব, পরিকল্পনার অভাব সর্বোপরি আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের অভাবে হাজীগঞ্জ তার বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। গড়ে উঠেনি শিল্প-কারখানা (ক্ষুদ্র ও মাঝারি), নেই টেকসই ব্যবসায়ীক শ্রেণি এবং নেই ব্যবসায়িক বৈচিত্রতাও। কারণ মানুষের পণ্য চাহিদার ৪০ ভাগও পূরণ হওয়ার মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হাজীগঞ্জে গড়ে উঠেনি। আর তাই এতদ্বঞ্চলের মানুষের পণ্য চাহিদা বা সেবা পণ্যের ৮০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব হাজীগঞ্জকে এমন বাণিজ্যিক অঞ্চলে গড়ে তোলার জন্য এখনই পরিকল্পণা গ্রহণ বাঞ্চনীয় আর তা সম্ভবও।

কোনো ব্যবসায়িক অঞ্চলে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে তোলে প্রতিটিতে প্রায় একই ধরনের পণ্য বিক্রির পসরা সাজানোকে ব্যবসায়িক সমৃ্দ্ধ বলে না। হাজীগঞ্জে এখন তা-ই হচ্ছে। তাই ব্যবসা ও বাণিজ্যের বৈচিত্রকরণ দরকার। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা বা ঢাকায় গিয়ে মানুষকে পণ্য ক্রয় করতে হয়- হাজীগঞ্জে এমন পণ্যের ব্যবসার প্রসার ঘটানো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলার জন্য সামর্থবান ব্যবসায়িক উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাবো। তাহলেই কেবল টেকসই ব্যবসায়ী শ্রেণি সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় অনেক লোকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। এজন্য হাজীগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে উদ্যোগী হওয়ার এবং উদ্যোক্তাদেরকে সহযোগিতার মনোভাব একান্তই প্রয়োজন।

আমরা যতটুকু জানি, হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদকে ঘিরেও হাজীগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিশাল এই মসজিদে নামাজ আদায় ও পরিদর্শনে প্রতিদিনই বহু মানুষের আগমন ঘটে হাজীগঞ্জে। বিশেষ করে শুক্রবার পুরো হাজীগঞ্জ শহরই পরিণত হয় জুমায় কাতারবন্দি মুসল্লিতে। বড় মসজিদ কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে হাজীগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক বহুতল ভবন তৈরি করেছে। যা হাজীগঞ্জ শহরের শ্রীবৃদ্ধি করাসহ ব্যবসায়িক জমজমাটকে আরও প্রসারিত করেছে। আমরা আহ্বান জানাবো- হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কর্তৃপক্ষের সামর্থ আছে, তারা যেন হাজীগঞ্জে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কোনো শিল্প কারখানা স্থাপনে নজীর সৃষ্টি করে। একইভাবে হাজীগঞ্জে অনেক ধনিক শ্রেণি আছে, তাদেরও বলবো হাজীগঞ্জে একটি শিল্পপার্ক গড়ে তুলুন এবং সেখানে বিনিয়োগ করুন। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। মানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই আসনের সাংসদকেও উদ্যোগ নিতে হবে। আমি নিশ্চিত আপনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাজীগঞ্জে শিল্পপার্ক ও ব্যবসায়িক বৈচিত্রতা শুরু হলে এমন অনেক উদ্যোক্তা আপনাদের অনুসরণে এগিযে আসবে। তাতে দূর হবে স্থানীয় বেকারত্ব, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মস্ংস্থান।

হাজীগঞ্জ ব্যবসায়ী সংগঠন নিয়ে আরও যৎসামান্য আলোচনা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। প্রথমেই বলবো, ‘হাজীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতি’- এই নামকরণ বর্তমানে আপত্তিমূলক, এর পরিবর্তন জরুরি। কারণ হাজীগঞ্জ এখন আর শুধুই বাজার নয়- একটি প্রথম শ্রেণির (A-Grade) পৌরসভা। মানে হাজীগঞ্জ প্রথম শ্রেণির শহরে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। দ্বিতীয়ত- শুধু টোরাগড়ের বড় পুলের পূর্ব পাশের ব্যবসায়ী বা মকিমাবাদের দোকানদারই নয়, আলীগঞ্জ বা ধেররা, মনিনাগ-রান্ধুনিমুড়া, বলাখাল বাজার ব্যবসায়ীদেরও হাজীগঞ্জ ব্যবসা সংগঠনের সদস্য করে নেওয়া বাঞ্চনীয়। এক কথায় হাজীগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত ছোট-বড় প্রত্যেক ব্যবসায়ী বা দোকানিকে হাজীগঞ্জ ব্যবসা সংগঠনের সদস্য করে নেওয়ার আহ্বান জানাবো। প্রয়োজনে এসব বাজার বা অঞ্চলকে ওয়ার্ডভিত্তিক ভাগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করা যেতে পারে। তৃতীয়ত হাজীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতিকে ‘হাজীগঞ্জ চেম্বার্স অফ কমার্সে’ পরিণত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সর্বাজ্ঞে প্রয়োজন। সর্বোপরি হাজীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।

জাকির মজুমদার
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

বাংলাদেশ সময়: ৩:৫২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১০ জুন ২০২০

protidin-somoy.com |

Development by: webnewsdesign.com