ঈদ মুবারক। এ শব্দ দু’টি কানে বাজলে কিংবা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই বাঙালির চিরায়ত এক অনুভূতি হয়। এ অনুভূতি আনন্দের। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ শব্দ দু’টি খুশির বার্তা নিয়ে আসে। হোক সেটা ঈদুল ফিতর, অথবা ঈদুল আজহা। তবে এবার ঈদুল ফিতরের সময় প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ শব্দ দু’টি সেভাবে স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারছে না। এর কারণও আমরা জানি। করোনাভাইরাস। এ বৈশ্বিক মহামারী আমাদের চিরায়ত আনন্দের শব্দ দু’টিকে বিষাদময় করে তুলেছে।
এবার এমন এক সময়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর আমাদের সামনে হাজির হয়েছে, যখন এই ঈদের দিনও বিশ্বের নানা প্রান্তে করোনাভাইরাস অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্বের অনেক মানুষ এই ঈদের দিনেও মহামারী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হবেন। এ ভাইরাস কতোটা ভয়ঙ্কর তা আমাদের নিশ্চয়ই নতুন করে বোঝাতে হবে না। গত ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ইতোমধ্যে আমরা তা জেনেছি।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, বিভিন্ন দেশে এখনও লকডাউন, কারফিউ চলছে। ঈদের নামাজ যেন মসজিদে গিয়ে জনসমাগম করে আদায় করা না হয় সেজন্য অনেক দেশ কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে। এমন অবস্থায় ঈদ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জন্য বিষাদময়, বা তার স্বকীয় ঐতিহ্যে হাজির হতে পারেনি। এরপরও জীবন থেমে থাকবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, সহসা এ মহামারী দূর হবে না। তাই ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে।
এমন প্রেক্ষাপটের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি শিথিল করা হয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত পরিবহনে ঈদে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটা ঝুঁকি বাড়ালেও বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের বিজ্ঞানীরাও যেহেতু বলছেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে কৌশলে মিতালী করে শরীরে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কথা, তাই এ বাস্তবতাকে আরও বেশি মেনে নিতে হবে। আর এটা মানতে হবে শরীরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই। তবে এর মানে এই নয় যে, করোনাভাইরাসকে পাত্তা না দিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো যাবে। এমনটা কোনোভাবেই করা যাবে না।
ঈদে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর অবশ্য এমনটাই দেখা গেছে। এসময় ভাড়ায় চালিত পরিবহনকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রুপান্তরের ঘটনাও ঘটেছে। ভাড়ায় নেওয়া প্রাইভেট কারকে ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এসব ভাড়ায় চালিত গাড়ির চালকরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে যাত্রী নেওয়ার কাজ করেছেন। ঠিক সিএনজিচালিত অটো রিকশায় যেভাবে মিটারে না গিয়েও পুলিশের কাছে মিটারে যাওয়ার কথা বলার সংস্কৃতি আছে, এখানেও ঠিক তেমন। ভাড়া গাড়ির যাত্রীরাও নিজেদের গাড়ির মালিক বলে পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও করোনাভাইরাসকে যে ফাঁকি দেওয়া যাবে না, সেটা তাদের চিন্তায় ছিল না। এর বিপরীত চিত্রও আছে। এমন অনেকেও আছেন যারা কষ্ট সত্ত্বেও পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বজনদের কাছ থেকে দূরে, যে যেখানে আছেন সেখানে অবস্থান করেই আমেজহীন ঈদ করছেন। তাদের এই ত্যাগ স্বীকারকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। এর বাইরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাবারের সংকটসহ কেউ কেউ ঝুঁকি সত্ত্বেও বাড়ি যাওয়ার যেসব কারণ মিডিয়ায় বলেছেন, তাতে তাদেরও তেমন দোষী করা যায় না।
বিশ্বব্যাপী যখন করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল, তখন সংক্রমণ প্রতিরোধে মক্কা-মদিনাসহ অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানেও মসজিদ, মন্দির কিংবা গির্জাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে গিয়ে এবাদত বা উপাসনায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। পরে একপর্যায়ে নিরাপত্তা মেনে চলার শর্তে মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে দোকানপাট, শপিংমল খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে শপিংমল তেমন না খুললেও জেলা পর্যায়ে খুলে আবার বন্ধ করতে হয়েছে। এর কারণ ছিল ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতনতার অভাব। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দোকানপাট খোলায় উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় তা আবার বন্ধ করতে হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনায় হয়তো মসজিদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিধিনিষেধ জারি করা হয়নি।
এরপরও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ বছর সব ধরনের গণ-জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঈদগাহ ময়দানের পরিবর্তে মসজিদে মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন যেহেতু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে, এর ওপর সুপার সাইক্লোন আম্পানে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলা ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাজেই স্বাভাবিক সময়ের মতো এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হলেও মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
এজন্য কোলাকুলি ও হ্যান্ডশেক থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। মসজিদে ঈদের জামাত এবং পরবর্তী সময়ে সামাজিক দূরত্ব নিজে থেকেই বজায় রাখতে হবে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা দিবস এবং বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানও জনসমাগম এড়িয়ে রেডিও, টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মাধ্যমে উদযাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে ঈদ জামাতে না গিয়ে বাসায় নামাজ আদায়, মসজিদে গেলেও বাসা থেকে অজু করে নিজস্ব জায়নামাজ নিয়ে যাওয়া, কোলাকুলি ও হ্যান্ডশেক না করা এবং ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। পরিস্থিতির শিকার হলে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয়। সেটা আমরা জানি। এক্ষেত্রে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ালে মক্কা-মদিনাসহ বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো না। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত এসেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেদের হাতে। নিজে সুরক্ষিত থাকলে যার যার পরিবার সুরক্ষিত থাকবে, প্রতিবেশি সুরক্ষিত থাকবে, দেশ সুরক্ষিত থাকবে।
করোনাক্রান্তিতে বিশ্বব্যাপী ঈদ মুবারক শব্দদ্বয়ও নিজের আমেজ হারিয়েছে
ঈদের আনন্দে এসব ভাবনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি এবার আমাদের সামনে আরও একটি বিষয় হাজির হয়েছে। মহামারীর কারণে প্রতিবেশি বা আশেপাশে যারা অসহায় হয়ে পড়েছেন তাদের আরও বেশি করে সহায়তা করা। ঈদ মানে সবাই মিলে খুশিতে থাকা। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। এজন্য আশেপাশের সবাইকে যথাসাধ্য ভালো রাখার চেষ্টা করে নিজেকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে। আমরা সবাই মিলে যদি ভালোভাবে এ মহামারী কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে মহামারী শেষে আবার আমরা আগের মতো ঈদ আনন্দে ও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারবো। ঈদের দিনে করোনামুক্ত পৃথিবী কামনা হোক সবার প্রধান চাওয়া। করোনাকালের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সবাইকে ঈদ মুবারক।
বাংলাদেশ সময়: ২:৩৬ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৫ মে ২০২০
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com