১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের নবযাত্রা শুরু হয়। প্রায় তখন থেকেই ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় আবারও শান্তির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তবে, তা টেকসই হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (মাঝে) সঙ্গে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা।
চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (মাঝে) সঙ্গে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা।
ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরিতার শুরু ১৯৮০-১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এসে সেই বৈরিতা ভুলে ইসলামি বিশ্বের দুদেশ আবারও মৈত্রীর পথে যাত্রা শুরু করেছে। এক নজরে দেখে নেয়া যাক সৌদি-ইরান বৈরিতা যেভাবে মৈত্রীতে রূপ নিল।
১৯৮০-১৯৮৮: এ সময়ে ইরাক ইরান আক্রমণ করে। মুখে মুখে সৌদি আরব নিরপেক্ষ থাকলেও বাস্তবে দেশটি তার তিনটি বন্দর সামরিক সরঞ্জাম-রসদ আনা নেয়া করতে ব্যবহার করতে দিয়েছিল ইরাককে।
১৯৮১: এ বছর সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনায় ইরানি হজযাত্রীদের সঙ্গে সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ইরানি হজযাত্রীরা সেখানে রাজনৈতিক স্লোগান দিয়েছিল বলে অভিযোগ করে সৌদি আরব। ইরান এ অভিযোগ উড়িয়ে বলে, সৌদি ইরানি হজযাত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। ওই বছরের মে মাসে ইরান এবং ইরাক উভয় দেশকে বাদ দিয়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান এবং বাহরাইন মিলে গঠন করে গালফ কো-অপরাশেন কাউন্সিল বা জিসিসি।
১৯৮২: এ বছর ইরাক-ইরান যুদ্ধের মধ্যেই সৌদি আরব প্রতি মাসে ইরাককে এক বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সহায়তা দিয়েছে।
১৯৮৪: ইরাক ইরানের তেল বহরে হামল চালানোর জবাবে ইরান সৌদি জলসীমায় সৌদি তেল ট্যাংকারে আক্রমণ চালায়। জবাবে সৌদি আরবও ইরানের ফ্যানটম যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে।
১৯৮৭: আবারও সৌদি আরবে ইরানের শিয়া মুসলিম ও সৌদি পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ। এ সময় পদদলিত হয়ে সবমিলিয়ে ৪০০ জন মারা যান। যার মধ্যে ইরানের নাগরিক ছিল দুই শতাধিক। জবাবে ইরানের নাগরিকরা তেহরানে কুয়েত এবং সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায়।
১৯৮৮: আগের বছর হজে পদদলিত হওয়ার ঘটনা এবং তেহরানে দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার জবাবে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে সৌদি আরব। সে বছরই ইরান হজ বয়কট করে। এই বয়কট চলে ১৯৯০ সাল অবধি।
১৯৯০: এ বছর ইরানে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এ ভূমিকম্পে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। সৌদি আরব সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। দেশটি বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা পাঠায় ইরানে।
১৯৯১: রিয়াদ-তেহরান কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও চালু।
১৯৮৯-১৯৯৭: ১৯৮৯ সালে আকবর হাশেমি রাফসানজানি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং সৌদি আরবসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতি আরও সমঝোতামূলক এবং নমনীয় অবস্থান নেন। দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও সরাসরি ফ্লাইট বৃদ্ধি পায়।
১৯৯৭-২০০৫: মোহাম্মদ খাতামি প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতায় আসেন এবং পারস্য উপসাগরে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেন। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর সৌদি কর্মকর্তারা ইরাকে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক হয়ে উঠেন।
১৯৯৭: সে সময় যুবরাজ ও বর্তমান রাজা আব্দুল্লাহ ওরফে সালমান বিন আব্দুল আজিজ তেহরানে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা-ওআইসির সম্মেলনে যোগদেন। যা ১৯৭৯ সালের পর দেশটিতে সৌদি আরবের শীর্ষ কোনো নেতার প্রথম সফর।
১৯৯৯: সালমান বিন আব্দুল আজিজের তেহরানের সফরের জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবে সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৯৭৯ সালের পর এটিই ছিল ইরানের কোনো শীর্ষ নেতার প্রথম সৌদি সফর।
২০০১: সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার রোধে সৌদি আরব ও ইরান একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে।
২০০৫-২০১৩: প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ক্ষমতায় আসেন এবং পররাষ্ট্র নীতিতে আরও কঠোর অবস্থান নেন। তেহরান এবং রিয়াদ ক্রমবর্ধমানভাবে লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক এবং আফগানিস্তানে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নামে।
২০১১: আরব বসন্ত দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। সৌদি কর্মকর্তারা ইরানর বিরুদ্ধে বাহরাইনের রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উসকানি দেয়ার অভিযোগ তোলে। সৌদি আরব সেই বিদ্রোহ দমন করতে ১ হাজার সৈন্য পাঠায়। মার্কিন বিচার বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত আদেল আল জুবেইরকে হত্যা চেষ্টার জন্য দুই ইরানিকে অভিযুক্ত করে।
২০১২: সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে শিয়াবিরোধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিক্ষোভ শুরু হয়। সৌদি আরব বিক্ষোভের জন্য ইরানকে দায়ী করে।
২০১৪: সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে শিয়া ধর্মগুরু নিমর আল নিমরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ইরানি কর্মকর্তারা সৌদি আরবের এই রায়কে তীব্র সমালোচনা করে।
২০১৫: ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সৌদি আরব দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে সমর্থন করে এবং হুথি বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা শুরু করে। বিপরীতে হুথিরা ইরানের কাছ থেকে সমর্থন পেতে থাকে। এ বছর মক্কায় হজে আবারও পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। মারা যায় ২ হাজারের বেশি মানুষ। যার মধ্যে ৪ শ জনেরও বেশি ইরানের।
২০১৬: মক্কায় পদদলিত হওয়ার ঘটনার চার মাস পর সৌদি আরব বিশিষ্ট শিয়া নেতা ও সৌদি সরকারের কড়া সমালোচক নিমর আল নিমরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রতিবাদে তেহরানে বিক্ষোভকারীরা সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায় এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নিমরের মৃত্যুদণ্ডের জন্য ‘আল্লাহর গজব’ বিষয়ে সৌদি আরবকে সতর্ক করেন। এরপর তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ।
সে বছর সম্পর্ক ছিন্ন করার জবাবে হজে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে ইরান। সৌদি আরব হজ কভার করার জন্য একটি ফার্সি ভাষার টেলিভিশন স্টেশন চালু করে। রিয়াদ জানায়, ২৪ ঘণ্টা স্যাটেলাইট চ্যানেলটি মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে হজের আচার অনুষ্ঠান এবং দুয়া কভার করবে। খামেনি সৌদি আরবের হজ পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করেন এবং মুসলিম দেশগুলোকে হজের ওপর রিয়াদের একক নিয়ন্ত্রণ শেষ করার বিষয়ে চিন্তা করার পরামর্শ দেন।
২০১৭: জুন মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে। দেশগুলোর অভিযোগ কাতার ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে ‘সন্ত্রাসবাদে’ অর্থায়ন করেছে। তবে দোহা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। পরে অবশ্য ২০২১ সালের শুরুতে দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিকের দিকে গড়ায়।
ওই বছরের নভেম্বর মাসে সৌদি সশস্ত্র বাহিনী রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করে। রিয়াদ দাবি করে যে, ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরান সরবরাহ করেছিল এবং তা ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের দখলকৃত এলাকা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। সে সময় সৌদি যুবরাজ তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনকে বলেছিলেন, ইরানের পদক্ষেপ সৌদি আরবকে যুদ্ধের দিকে চালিত করতে পারে।
একই মাসে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি রিয়াদে অবস্থানের সময় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি অভিযোগ করেন, হিজবুল্লাহর মাধ্যমে তার দেশের ওপর ইরান নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা করছে। পরে অবশ্য তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন। সাদ হারিরির এ পদক্ষেপ লেবাননকে একটি রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত করেছিল যা দেশে ইরানের প্রভাব প্রতিহত করার সৌদি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখেছিলেন অনেকে।
২০১৮: মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। সৌদি আরব এবং ইসরাইল উভয় দেশই এ পদক্ষেপের প্রশংসা করে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এক মার্কিন টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ‘তেহরান যদি পরমাণু অস্ত্র পায় তাহলে আমরাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে পথেই হাঁটব।’ যুবরাজ ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ‘নতুন হিটলার’ বলেও উল্লেখ করেন।
২০১৯: সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করে ধারাবাহিক হামলা চালানো হয়। সৌদি আরব এসব ধারাবাহিক হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে। এসব হামলায় সৌদি আরবের তেল উৎপাদন অল্প সময়ের জন্য অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। তবে ইরান বারবার এসব হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে।
২০২০: কাসেম সোলেইমানিরে মৃত্যুতে সৌদির উল্লাস। বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি নিহত হলে সৌদি আরবের সরকারি গণমাধ্যমে ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।
২০২১: ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে আলোচনা শুরু। সম্পর্কচ্ছেদ করার পর ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে প্রথম সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালে এপ্রিলে। আয়োজক ছিল বাগদাদ।
২০২২: ২০২১ সালের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চার দফা আলোচনা হয়। বেশিরভাগ আলোচনা অনুষ্ঠিত ইরাক ও ওমানের মধ্যস্থতায়। এ বছর ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পঞ্চম দফা আলোচনার পর খামেনির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা সৌদি ও ইরানের দূতাবাস পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ইরান-সৌদি সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করেন।
২০২৩: সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চুক্তি। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ফেব্রুয়ারিতে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চীন সফর করেন। পরের মাসে (মার্চ) রিয়াদ এবং তেহরান ঘোষণা করে যে তারা সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩
protidin-somoy.com | anayet mojomdar
Development by: webnewsdesign.com