ব্রেকিং নিউজ

x


অভিজাত এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসার লাইসেন্সেই চলছে অবৈধ স্পা-পার্লার

বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

অভিজাত এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসার লাইসেন্সেই চলছে অবৈধ স্পা-পার্লার

 

রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে গড়ে উঠা গুটিকয়েক স্পা ও পার্লার সরকারের নিয়মনীতি মেনে চললেও তার উল্টো চিত্রই দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের সেক্সুয়াল ইঙ্গিতমূলক চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্লায়েন্ট ডেকে যুবক দিয়ে যুবতীদের এবং যুবতী দিয়ে যুবকদের স্পা করানো হয়। ওই সময়ের প্রায় উলঙ্গ ছবি বা ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা দিয়ে পরবর্তীতে ব্লাকমেইলিং করার ঘটনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরি বাঙালি তরুণী ছাড়াও থাই, নেপালি বা অন্য কোনেও বিদেশি তরুণীদেরও ব্যবহার করার তথ্য রয়েছে। এছাড়াও ওইসব স্পটে গ্রুপবেঁধে চলে অবৈধ কর্মকাণ্ড, ঠিক যেন মধুচক্রের আসর।

ঢাকা মহানগরীতে প্রকাশ্যে ঠিক কতো সংখ্যক স্পা-পার্লার রয়েছে তার নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা নেই কারোই! কেবল তাই নয়, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরাসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে সীমিত আকারে স্পা-পার্লারের নামে চলছে জমজমাট দেহ ব্যবসা। ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ‘ক্ষুদ্র ব্যবসার’ লাইসেন্স নিয়ে এসব অভিজাত এলাকায় কেবল দেহব্যবসা নয়, মাদকের রমরমা ব্যবসারও তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

গত মাসের (সেপ্টেম্বর) ২০ তারিখে গুলশান-২ নম্বর এলাকায় ‘আপেল থাই স্পা’ ও ‘ছোঁয়া বিউটি পার্লারের’ আড়ালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উঠতি বয়সের যুবতী নিয়ে দেহ ব্যবসা করানোর তথ্য পাওয়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। সেই অভিযান শেষে পুলিশ জানায়, অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত ও পতিতাবৃত্তির জন্য ১২ জন পুরুষ ও ১৬ নারীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিলে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পতিতাবৃত্তির কথা স্বীকারও করে। পরে তাদের ২৮ জনকেই গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করলে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. শাহ আবিদ হোসেন আরটিভি নিউজকে বলেন, আইন বহির্ভূত এবং অবৈধ কোনও কর্মকাণ্ডকে আমরা প্রশ্রয় দেই না। অবৈধ স্পা-পার্লারের বিরুদ্ধে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এই নজরদারির মধ্যে এবং কোনও ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেলে সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এই ঘটনায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক তাদের কোনও প্রকার ছাড় দেয়া হয় না।

একই বিষয়ে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসান আরটিভি নিউজকে বলেন, গত সেপ্টেম্বরের অভিযানের গ্রেপ্তারকৃত ২৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ দমন আইনে মামলা দায়ের হয়েছে। আমরা যখনই কোনও অবৈধ স্পা পার্লারের তথ্য পাই তখনই দেরি না করে সেখানে অভিযান চালাই। কিন্তু যারা লাইসেন্স নিয়ে নীতি নৈতিকতা ঠিক রেখে স্পা-পার্লার চালাচ্ছেন তাদের বিষয়ে আমাদের কোনেও অ্যাকশন নেই। তবে যারা পরস্পর যোগসাজশে সংঘবদ্ধভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পতিতালয় স্থাপন করে, তা চালিয়ে যাচ্ছে, পতিতাবৃত্তির উদ্দেশে আহ্বান করে যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাকশন অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন সময়ে আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে, গুলশান ও বনানী এলাকায় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক স্পা-পার্লার ও থেরাপি সেন্টার রয়েছে। এছাড়াও ধানমন্ডি, উত্তরাসহ কয়েকটি অভিজাত এলাকায় নতুন করে গজিয়ে উঠেছে আরও বেশ কিছু স্পা-পার্লার। এসবের অধিকাংশের আড়ালে চলছে অবৈধ দেহ ব্যবসা এবং মাদকের রমরমা ব্যবসা। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যায়, স্থানীয় থানা পুলিশের কোনও কোনও অসাধু সদস্য এবং প্রভাবশালী কয়েকজনের মদদে চলছে এসব অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গুলশানের নাভানা টাওয়ারে অবস্থিত ‘লাইফ স্টাইল স্পা’, ‘রেসিডেন্স সেলুন অ্যান্ড স্পা’ ও ‘ম্যাংগ স্পা’তে দীর্ঘদিন যাবত উঠতি বয়সী তরুণী ও নারীদের দিয়ে অবৈধ দেহ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই সময়ে এসব পরিচালনার মূল হোতা ৩ জনের নাম জানা যায়, যারা আজ পর্যন্ত অধরাই রয়েছে গেছে। তারা হলেন- সুমন খান কিং, রায়হান ও নুরুল ইসলাম নাহিদ। তথ্য রয়েছে, পলাতক এই ৩ জন এখনো আড়ালে থেকে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছে। তবে তখন ঘটনাস্থল থেকে ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে এমন একটি ঘটনা তদন্তে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পুলিশ জানতে পারে, ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে একাধিক প্রতারক চক্রের সদস্য। লাইসেন্স নেয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরণের ব্যবসা করছে, সেদিকে নজরদারী করে না সংশ্লিষ্টরা। এমন গা ছাড়া সুযোগটি’ই কাজে লাগিয়ে স্পা, ফিটনেস ও থেরাপি সেন্টার খুলে এর আড়ালে চালানো হয় রমরমা দেহ ও মাদক বাণিজ্য।

২০১৮ সালের ওই দিনে গুলশান ও বনানী এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে, এমন ৫টি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৫৩ জনকে আটক করা হয়েছিল। ওই অভিযানটি চালিয়েছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগ। তাদের আটকের পরই ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকার অন্ধকার ব্যবসার গোপন খবর প্রকাশ হয়। ওই সময়ে যাদের আটক করা হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে ৮ জনকে ‘পতিতাবৃত্তি’ ও ‘দাসত্বে’ বাধ্য করায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানটি চালানো হয়েছিল।

তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গুলশানের এ্যাপল থাই স্পা, ছোঁয়া বিউটি পার্লার, লাইফ স্টাইল স্পা, রেসিডেন্স সেলুন অ্যান্ড স্পা ও ম্যাংগ স্পা, ডব্লিউ বিউটি অ্যান্ড স্পা, হোয়াইট বিউটি সেলুন অ্যান্ড স্পা সেন্টার, মহাখালী ডিওএইচএসের ফনিক্স হেলথ কেয়ার, ডায়মন্ড বিউটি অ্যান্ড স্পায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক সম্পৃক্তাকে আটক করে পুলিশ।

গুলশানের একটি স্পায় সার্ভিস নিতে গিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘হোয়াইট বিউটি সেলুন অ্যান্ড স্পা সেন্টারে’ প্রায় খোলামেলা অবস্থায় আমার শরীর ম্যাসেজ করানো হয়। ওই সময়ে আমাকে না জানিয়ে আপত্তিকর ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়, যা পরে আমি জানতে পারি। সার্ভিস নেয়ার কয়েক দিন পর আমাকে ফোনে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ১০ লাখ টাকা না দিলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। পরে আমি ৫ লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করি এবং পুলিশের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগও করি। যে ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা, গুলশান ও ধানমন্ডিতে বডি ম্যাসাজ পার্লারের আড়ালে অপরাধীরা মাদক ও সুন্দরি মেয়েদের দিয়ে দেহব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বডি ম্যাসাজ পার্লারে দাগী অপরাধী থেকে শুরু করে শিল্পপতিরাও আসা যাওয়া করে। পার্লারের মালিকরা সব সময় গেস্টদের আড়ালে থেকে এবং নিজেদের আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের আত্মীয় বা কাছের কেউ পরিচয় দিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ ঢাকা।
চলতি বছরের ৯ আগস্ট চট্টগ্রামের খুলশি থানা এলাকার লাক্সারি বিউটি পার্লারে গোপনে দেহ ব্যবসা পরিচালনা ও সেখানে শিশুদের যৌনকাজে বাধ্য করা এবং অসামাজিক কালে লিপ্ত হওয়ার দায়ে ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় পৃথক ২টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। আটক ২ জন হলেন- রহিমা আক্তার ডলি (৪৯) ও ইয়াসমিন আক্তার মুন্নি (৪০)। রহিমা আক্তার ডলি দীর্ঘদিন ধরে লাগজারি বিউটি পার্লার নাম দিয়ে ঘরের সামনের অংশের একটি কক্ষে পার্লার সাজিয়ে ভেতরে এ অসামাজিক কাজ করে আসছিল বলে জানান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (বায়েজিদ জোন) পরিত্রান তালুকদার।

এদিকে রাজধানী ঢাকার গুলশানে গোয়েন্দারা অনুসন্ধান করে জানতে পারে, রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর এলাকায় হোটেল লেকশোর পাশের বিল্ডিংয়ে গড়ে উঠেছে অ্যারোমা থাই স্পা, সিটি স্পা ও ল্যাসি কেয়ার নামে ৩টি স্পা সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এসব স্পায় হরদমে চলে অবৈধ মাদক ও দেহব্যবসা। উঠতি বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদেরকে দিয়ে স্পার নামে চালানো হয় মাদক ও দেহব্যবসা।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্পা-পার্লার ব্যবসায়ী বলেন, হাতেগোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের কারণে আমরা যারা বৈধভাবে ব্যবসা করছি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তেমনি যারা সেবা নিতে আসেন, তারাও আস্থার সংকটে ভুগছেন। বাংলাদেশে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের কোনও নীতিমালা না থাকার ফলে বৈধতার ব্যানারে অবৈধ ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী স্পা বা ম্যাসাজ একজন পেশাদারি থেরাপিস্টরা দিয়ে থাকেন। তিনি নারী বা পুরুষ যে কেউ হতে পারেন। বিদেশে গেলে দেখবেন বেশিরভাগ থেরাপিস্ট মেয়েরাই থাকে। তারা ছেলে মেয়ে সবাইকেই সার্ভিস দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষ বা নারীর সেই মন মানসিকতা গড়ে ওঠেনি যে তারা জেন্ডারগত পার্থক্য মাথায় না নিয়ে থেরাপিস্টের সার্ভিসটা কেবলমাত্র সার্ভিস হিসেবেই নেবেন। তাছাড়া আমাদের ধর্মীয় কিছু বিধি-নিষেধতো রয়েছেই। মূল সমস্যা হলো আমাদের কোও নীতিমালা নেই যেখানে বলা থাকবে, কোনও স্পা বা ম্যাসাজ পার্লার গড়ে তুলতে হলে কী ধরণের নিয়ম মানতে হবে। সম্প্রতি যে অভিযানটি চালানো হয়েছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ৭:১১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০২০

protidin-somoy.com |

Development by: webnewsdesign.com